শিক্ষার্থীদের ৯ দাবি মানল সরকার, ঘরে ফেরার অনুরোধ

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চার দিন ধরে রাজধানীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীদের আহ্বান করব, তাদের সমবেদনার কথা আমরা জেনেছি। দেশব্যাপী এই মেসেজ পৌঁছেছে। আমরাও ব্যথিত। আমাদের প্রিয় ছেলে-মেয়েরা বিদায় হয়েছে, সে জন্য আমরাও ব্যথিত। অনুরোধ করব, তোমাদের দাবি সবই মানা হয়েছে। যারা ঘাতক, যারা অন্যায় করেছে, আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি যেন তারা পায়, সে ব্যবস্থা আমরা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের সব দাবি মেনে নিয়েছি। সবগুলোই মনে হয় যৌক্তিক। আমরা কোনোক্রমে লাইসেন্সবিহীন, রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলতে দেব না।’

গত রবিবার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় দুই ছাত্র-ছাত্রীর মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানী অচল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই অনুরোধ জানান। বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ছাড়াও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা, পুলিশের মহাপরিদর্শক ডক্টর মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পরিবহন নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দোষীরা যাতে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি পায়, তার জন্য সব ব্যবস্থা আমরা নেব। অভিভাবক ও শিক্ষকদের অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের সন্তান ছাত্রদের তারা যেন ফিরে আসে। ক্লাসরুমে চলে আসে। যা হচ্ছে, এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। সারা শহর আজকে অচল হয়ে যাচ্ছে, এটা কারো কাম্য নয়। যারা অবরোধ করছে, তাদেরও কাম্য নয়। যারা আমরা রাস্তায় চলাচল করছি, তাদের জন্য কাম্য নয়। আমরা আশা করব ছাত্র-ছাত্রী ভাই-বোনেরা তাদের অবরোধ প্রত্যাহার করবে।’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আন্দোলনে একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। এটা কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ নয়। এটা স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ। গত তিন দিনে ৩০৯টি গাড়ি ভাঙা হয়েছে, পোড়ানো হয়েছে আটটি গাড়ি। ২৯ তারিখ ১৫০টি গাড়ি ভেঙেছে, ৩০ তারিখে ২৫টি গাড়ি ভেঙেছে এবং ৩১ তারিখে ১৩৪টি গাড়ি ভেঙেছে। মোট ৩০৯টি গাড়ি ভেঙেছে। পোড়ানো হয়েছে আটটি গাড়ি। এর মধ্যে পুলিশের দুটি, ফায়ার সার্ভিসের একটি, যা পুলিশের ক্ষতি, ফায়ার সার্ভিসেরও ক্ষতি। এই যে আমার কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা অবরোধ করছে; একে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নতুন করে জ্বালাও-পোড়াও ও গাড়ি ভাঙছে।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘অনুরোধ করব, আমাদের প্রিয় কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে। দোষীরা যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি পায়, তার ব্যবস্থা নেব। সরকার ব্যবস্থা নেবে। তারা বিভিন্নভাবে দাবি-দাওয়া আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছে। আমরা সবগুলো মেনে নিয়েছি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিন দিন হয়ে যাচ্ছে, আমাদের সন্তানরা রাস্তায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও চান, আমাদের প্রিয় সন্তানরা রাস্তা থেকে ফিরে আসুক। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক।’

সড়ক পরিবহনে দীর্ঘদিনের সমস্যা হুট করে কিভাবে সমাধান হবে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যথার্থ বলেছেন। আমাদের ইনটেনশন হলো যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। সবাই যেন আইন মেনে চলে। মালিক, শ্রমিক ও পথচারীরা আইনটা মেনে চলে। পথচারীরাও ভুল করে। সবাই যাতে মেনে চলে, তার জন্য আমরা আইনটা করতে চাইছি।’

গত রবিবার জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবিগুলো হলো—১. বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. প্রতিটি সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে। ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।

সূত্র জানায়, সংবাদ সম্মেলন হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি রুদ্ধধার বৈঠক করেন। বৈঠকে যানবাহনের রুট পারমিট, ফিটনেস ও চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ভুয়া চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আটক করা হলে মালিকপক্ষ আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। তাতে অপরাধীরা সাহস পেয়ে যায়। বৈঠকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বলা হয়, এখন থেকে পুলিশ ওই সব যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে।

বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত হয়, নির্দিষ্ট টার্মিনাল বা স্থান থেকে গাড়ি ছাড়ার আগে মালিক পক্ষ বা পরিবহন নেতাদের নিশ্চিত হতে হবে যে ওই গাড়ির রুট পারমিট, ফিটনেস বা চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না। যদি থাকে তাহলে গাড়ি গন্তব্য স্থানে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। তা ছাড়া চালকদের মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট বেতন দেওয়া যায় কি না সেটি বিবেচনায় আনার অনুরোধ করা হয়েছে মালিকদের কাছে।